ঢাকা, ৯ জুন ২০১৮। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে বাদ্যযন্ত্র গ্যালারি নতুনভাবে সজ্জিত করা হয়েছে। নতুনভাবে সজ্জিত গ্যালারি সকাল ১১:৩০ মিনিটে উদ্বোধন করা হয়। এ উপলক্ষ্যে কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক জনাব ফয়জুল লতিফ চৌধুরী নতুনভাবে সজ্জিত গ্যালারিটি উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইতিহাস ও ধ্রুপদী শিল্পকলা বিভাগের কীপার ড. স্বপন কুমার বিশ্বাস, জাতিতত্ত্ব ও অলংকরণ শিল্পকলা বিভাগের কীপার জনাব নূরে নাসরীন, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সংরক্ষণ রসায়নবিদ জনাব মো. আকছারুজ্জামান নূরী এবং সমকালীন শিল্পকলা ও বিশ্বসভ্যতা বিভাগের উপ-কীপার জনাব শক্তিপদ হালদার। সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সচিব জনাব মো. শওকত নবী।
আলোচনায় সমকালীন শিল্পকলা ও বিশ্বসভ্যতা বিভাগের উপ-কীপার জনাব শক্তিপদ হালদার বলেন, বাদ্যযন্ত্র সঙ্গীতোপযোগী শব্দ সৃষ্টিকারী যন্ত্র। এগুলো কণ্ঠসঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীতে ব্যবহৃত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে খননকার্য ও প্রাচীন সাহিত্য থেকে অতি উন্নতমানের এক সাঙ্গীতিক সভ্যতার পরিচয় পাওয়া যায় এবং সেই সূত্রে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রেরও পরিচয় মেলে। সিন্ধুসভ্যতায় বেণু, বীণা ও মৃদঙ্গের ব্যবহার ছিল বলে জানা যায়। বৈদিক যুগে দুন্দুভি, ভূমি-দুন্দুভি, বেণু, বীণা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার প্রচলিত ছিল।
জাতিতত্ত্ব ও অলংকরণ শিল্পকলা বিভাগের কীপার জনাব নূরে নাসরীন বলেন, অতীতে বঙ্গদেশে যেসব বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হতো সেসবের অনেকগুলোই বর্তমানে বিলুপ্ত বা অব্যবহৃত; আবার বর্তমানে অনেক নতুন যন্ত্রেরও আবির্ভাব ঘটেছে। লোকবাদ্যযন্ত্র প্রধানত ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়। হিন্দুদের পূজা-পার্বণে ঢোল-কাঁসর-শঙ্খধ্বনি অত্যাবশ্যক। কোনো কোনো দেবতার মূর্তিকল্পনায়ও বাদ্যযন্ত্রের যোগসূত্র লক্ষ করা যায়। শঙ্খধারী বিষ্ণু, ডমরুধারী শিব, মুরলীধারী কৃষ্ণ এবং বীণাধারিণী সরস্বতীর মূর্তি এভাবেই কল্পিত হয়েছে। বাদ্যযন্ত্রের প্রভাবে সরস্বতী ‘বীণাপাণি’ এবং কৃষ্ণ ‘মুরলীধর’ নামে পরিচিত। মুসলমানদের বিবাহানুষ্ঠানে সানাই বাজানো হয়, আর হিন্দু বিয়েতে বাজানো হয় সানাই, শঙ্খ, ঢোল, কাঁসর ইত্যাদি। শুধু তা-ই নয়, হিন্দুদের মধ্যে শঙ্খধ্বনি ও উলুধ্বনি দিয়ে বধূবরণ ও নবজাতকের আবির্ভাব ঘোষণা করা হয়। এছাড়া শবযাত্রা, শোভাযাত্রা এবং যুদ্ধযাত্রায়ও শঙ্খধ্বনির প্রয়োজন হয়; কাড়া-নাকাড়া, শিঙ্গা, দামামা, বিউগল প্রভৃতি যুদ্ধের বাদ্যযন্ত্র।
ইতিহাস ও ধ্রুপদী শিল্পকলা বিভাগের কীপার ড. স্বপন কুমার বিশ্বাস বলেন, প্রথম যে যন্ত্রটিকে বাদ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তার উৎস ও সময়কাল বিতর্কিত। সর্বপ্রাচীন যে বস্তুটিকে কিছু সংখ্যক বিজ্ঞ বাদ্যযন্ত্র হিসেবে নির্দেশ করেছেন, তা সম্ভবত একটি সাধারণ বাঁশি, যার বয়স আনুমানিক প্রায় ৬৭,০০০ বছর। কিছু কিছু মতামত অনুযায়ী অবশ্য প্রাচীন বাঁশিসমূহের বয়স অনুমান করা হয় প্রায় ৩৭,০০০ বছর। যাহোক, অধিকাংশ ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে, বাদ্যযন্ত্রের আবিষ্কারের সুস্পষ্ট সময় খুঁজে বের করা অসম্ভব। কারণ, বাদ্যযন্ত্রের সংজ্ঞার প্রাসঙ্গিকতা ও বাদ্যযন্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত উপকরণসমূহের অনির্দিষ্টতা বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে সুষ্ঠু ধারণার অন্তরায়। অনেক প্রাচীন বাদ্যযন্ত্রসমূহ বানানো হতো পশুর চামড়া, হাড়, কাঠ এবং অন্যান্য অস্থায়ী উপকরণ দ্বারা। বিশ্বের প্রায় সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠীই নৃত্যগীতপ্রিয়। পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় যে কোন উৎসব-অনুষ্ঠান ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র সহকারে তারা একক বা দলীয় নৃত্যগীতি পরিবেশন করে। বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীসমূহও তাদের এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রবহমান রেখেছে।
সংরক্ষণ রসায়নবিদ জনাব মো. আকছারুজ্জামান নূরী বলেন, বাদ্যযন্ত্রকে কেন্দ্র করে বাংলার লোকসমাজে নানা আচার-সংস্কারও প্রচলিত আছে। শঙ্খ ও সানাই কল্যাণকর বাদ্যযন্ত্র হিসেবে গণ্য হয়; আবার রাতে বাঁশি বাজানো অমঙ্গলজনক বলে একটি সংস্কারও প্রচলিত আছে। এভাবে লোকজীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে লোকবাদ্যের পরিবেশনানির্ভর সম্পর্ক সভ্যতার সূচনা থেকেই। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এত বিচিত্র বাদ্যযন্ত্র পাওয়ার কারণ বাঁশ, কাঠ, লোহা, তামা, চামড়া, মাটি, বেত ইত্যাদির সহজলভ্যতা ও প্রাচুর্য। লোকবাদ্যযন্ত্রের উপকরণ নিতান্তই প্রাকৃতিক এবং এর গঠন-প্রণালিও সহজ-সরল। লাউয়ের খোল, বেল বা নারকেলের মালা, বাঁশ, কাঠ, নল, পাতা, মাটি, লোহা, পিতল, সুতা, তার, শিং, শঙ্খ প্রভৃতি উপাদান দিয়ে এসব বাদ্যযন্ত্র নির্মিত। কিছু বাদ্যযন্ত্রে প্রাকৃতিক উপাদান প্রায় অবিকৃত থাকে, যেমন শঙ্খ ও শিঙ্গা। তালপাতা দিয়ে পাতাবাঁশি তৈরি হয়। মাটির সাধারণ হাঁড়ি বা ছোট কলসিও তালবাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কচি আমের আঁটি ঘষে ভেঁপু তৈরি করা হয়।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক জনাব ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, বাজনা গানের সহযোগী। তবে গান ছাড়াও বাজনা বাজে, যাকে বলা হয় যন্ত্রসংগীত। অন্যদিকে, শোভাযাত্রা, শবযাত্রা, যুদ্ধযাত্রা ইত্যাদিতে প্রাচীনকাল থেকেই বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার লক্ষণীয়। কিন্তু যেখানেই বা যে উদ্দেশ্যেই বাজুক, বাজনায় বাদ্যযন্ত্র লাগে।বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক উৎস থেকে বাংলায় বাদ্যযন্ত্রের বিভিন্নতা ও ব্যবহারের ব্যাপ্তির প্রমাণ পাওয়া যায়। নওগাঁর পাহাড়পুর (খ্রি. ৮-১২ শতক), কুমিল্লার ময়নামতিতে (খ্রি. ৭-১২ শতক) পাওয়া পোড়ামাটির ফলক ও পাথরের ভাস্কর্যে উৎকীর্ণ নানা মানব বা দেব-দেবীর মূর্তির সঙ্গে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, যেমন কাঁসর, করতাল, ঢাক, বীণা, বাঁশি, মৃদঙ্গ ও মৃৎভান্ড ইত্যাদির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। দশম শতাব্দীতে রচিত বাংলা ভাষার প্রথম নিদর্শন চর্যাপদে গীত-নৃত্য-বাদ্যের বর্ণনা রয়েছে। চর্যার তিনটি পদে মোট সাতটি বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ আছে: বীণা, পটহ, মাদল, করন্ড, কসালা, দুন্দুভি ও ডমরু। ত্রয়োদশ শতকে রচিত ‘শূন্যপুরাণে পূজা উপলক্ষ্যে ঢাক, ঢোল, কাড়া, মৃদঙ্গ, মন্দিরা, ডমরু, দুন্দুভি, বরঙ্গ, ভোর, ধীরকালি, শঙ্খ, শিঙ্গা, জয়ঢাক, দামামা, খমক প্রভৃতিসহ বিয়াল্লিশ ধরনের বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। মধ্যযুগে উপমহাদেশে মুসলমান শাসকদের আগমনের ফলে প্রচলিত ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটে। বাদ্যযন্ত্র এর বাইরে ছিল না। সানাই ও নহবত জাতীয় যন্ত্র মুসলমানদের অবদান। পরবর্তীকালে ইংরেজ শাসনামলে এ দেশের সংগীতে পাশ্চাত্য প্রভাব দেখা যায়। বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত হারমোনিয়াম, বেহালা, গিটার, বিউগল ইত্যাদি সেই সাক্ষ্য বহন করে। আজ বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে দীর্ঘ ৬ বছর পর বাদ্যযন্ত্র গ্যালারিটি জন সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সচিব জনাব মো. শওকত নবী বলেন, বিশেষ কায়দায় দীর্ঘ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আয়ত্তে আনতে হয় যে বাদ্যযন্ত্র, তা স্বয়ংসিদ্ধ বাদ্য। আর যে বাদ্যচর্চা জীবনাচরণ ও লোকাচারের অংশ, তা অনুগতসিদ্ধ বাদ্য। সব স্বয়ংসিদ্ধ বাদ্য যেমন শাস্ত্রীয় নয়, আবার সব অনুগতসিদ্ধই লোকবাদ্য নয়। তাল-লয়-সুর প্রকাশে শাস্ত্রীয় বাদ্য অনেকটা স্বাধীন এবং তা লোকসংগীতেও ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু লোকবাদ্য শাস্ত্রীয় সংগীতে সংগত করা ততটা বৈশিষ্ট্যধারী হয়ে ওঠেনি। বলা যায়, শাস্ত্রীয় বাদ্যকে পদ্ধতিগত অনুশীলনের মধ্য দিয়ে বশে আনতে হয়। লোকবাদ্যে এর প্রয়োজন হয় না। আর এই অনুগতসিদ্ধ বাদ্য অর্থাৎ লোকবাদ্য যন্ত্রের ধরন ও ব্যবহারের বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বাংলা ও বাঙালি।