ঢাকা, ২৫ জুন ২০১৮। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের উদ্যোগে ও অবিন্তা গ্যালারি অব ফাইন আর্টস- এর সহযোগিতায় বিকেল ৩টায় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনী গ্যালারিতে ‘সাহসী ভাস্কর্যের ভুবন’ শীর্ষক ভাস্কর আইভি জামানের চতুর্থ একক ভাস্কর্য ও পেইন্টিং প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।
প্রদর্শনীতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান নূর এমপি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান, বিশিষ্ট কার্টুনিস্ট ও চিত্রশিল্পী অধ্যাপক রফিকুন নবী, প্রখ্যাত নগরবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম এবং বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী। সম্মানিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও শিল্প সমালোচক অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর।
স্বাগত বক্তব্যে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক জনাব মো. আব্দুল মান্নান ইলিয়াস বলেন, আইভী জামান এখন এদেশের বিখ্যাত একজন ভাস্কর্য শিল্পী। তার ছবি দেশ-বিদেশে বিখ্যাত। এদেশের ১২টি বিখ্যাত ভাস্কর্য শিল্প তার করা। পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়ার বাড়িতে বেগম রোকেয়ার মূর্তিটি আইভি জামানের করা। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের নিয়মিত কার্যাবলির অংশ হিসেবে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে বলেও তিনি জানান। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন এই প্রদর্শনী ভাস্কর্য শিল্পের প্রতি আগামী প্রজন্মকে আগ্রহী করে তুলবে।
শিল্পী আইভি জামান অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, এদেশের মেয়েরা এখনো ভাস্কর্য পড়ালেখার পরেও এ নিয়ে কাজ করতে সাহস পায় না। তিনি বলেন, এদেশের নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তি দরকার। তাহলেই কেবল তাদের কাজের সুযোগ ও সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।
অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, শিল্পীরা সবসময় সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কাজ করেন। মানুষের রুচি তৈরি করতে এবং সুন্দর সমাজ গঠনে শিল্পীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। একটি গঠনমূলক এবং সৃজনশীল সমাজ প্রতিষ্ঠায় শিল্পীরা নিরলস কর্মী। তিনি আরও বলেন, এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে নবীন শিল্প শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র তাদের শিল্পকর্মের পসরা নিয়ে হাজির হবে না, পাশাপাশি সুন্দর মননশীল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালনের বিষয়েও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবে।
অধ্যাপক রফিকুন নবী বলেন, আইভি তাঁর নিজের ধরনে স্পেস ও ম্যাসের ভাস্কর্যভিত্তিক সম্পর্ক বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করতে থাকেন। আইভি ধরতে পেরেছেন কোনো একটি অবজেক্টের ম্যাস এবং তার চারপাশকার নেগেটিভ স্পেস হচ্ছে ইলিউশন। এই দুরূহ আইডিয়াকে তিনি বিভিন্ন স্ট্যাচুর মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করেছেন। এসব কাজে তিনি স্পেসকে ম্যাসের ভেতর ঢেলে দিয়েছেন, আবার স্পেসের চারপাশে ম্যাসকে ঘেরাও করেছেন, এভাবে ম্যাস ও বাইরেকার স্পেসের সীমারেখা ঘুচিয়ে দিয়েছেন।
সমরজিৎ রায় চৌধুরী বলেন, আইভি তাঁর স্বামীকে (ভাস্কর হামিদুজ্জামান) অনুসরণ করেননি। স্পেস থেকে বিভিন্ন ফর্ম গড়েছেন। সমগ্র স্তব্ধতার মধ্যে আইভি গতি খুঁজেছেন, পাথর, মার্বেল, কিংবা কাঠের চিন্তা তাঁকে ভর করেছে, ভাস্কর হিসেবে তাঁর প্যাশন হচ্ছে পাথর, মার্বেল, কিংবা কাঠের মধ্যে নিজেকে রূপান্তরিত করা। তাঁর চারপাশে আছে শূন্য : শূন্যের ভয় তাঁর আছে। ভয় ও আতঙ্ক তিনি নিজের মধ্যে অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতা করে তোলেন, এই ভয় হচ্ছে তাঁর নিজের মধ্যকার ক্রোধ : এই ক্রোধ জয় করে তিনি নিজের সঙ্গে কথা বলেন। এই কথা বলাটাই তাঁর কাজ।
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, নভেরার দেশ বাংলাদেশ। ১৯৬০ সালে ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরিতে ৭৫টি ভাস্কর্য নিয়ে নভেরা আহমেদের প্রদর্শনী হয়। এটি বোধহয় উপমহাদেশের প্রথম কোনো নারী ভাস্করের প্রদর্শনী। অথচ নভেরার পর এদেশ গুটি কয়েক নারী ভাস্করের দেখা পেয়েছে। তিনি বলেন আইভি জামান এদেশের ভাস্কর্য শিল্পের এক পরিচিত মুখ। তার কাজ অন্যান্যদের থেকে আলাদা। এই প্রদর্শনীর সাফল্য কামনা করে তিনি বলেন, নারীদের এই শিল্পের প্রতি আগ্রহী করে তুলবে।
ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান বলেন, প্রদর্শনীর অধিকাংশ কাজই বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও নিপুণতা রয়েছে অনেক ভাস্কর্যে। সেসব দেখলে হৃদয় প্রফুল্ল হবে। দেশের ভাস্কর্যচর্চা এগিয়ে যাচ্ছে জানিয়ে হামিদুজ্জামান খান আরো বলেন, বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে ভাস্কর্যচর্চা কিছুটা স্থিমিত ছিল অনেক দিন। প্রতিবন্ধকতা পেরিয়েই আমাদের ভাস্কর্যশিল্প এগিয়ে যাচ্ছে, বিকশিত হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও চর্চা বেড়েছে। ভাস্কর্যশিল্পের প্রসার ও বিকাশের জন্য সরকারি পর্যায়েও সহযোগিতা রয়েছে।
জনাব আসাদুজ্জামান নূর এমপি বলেন, বাংলাদেশ এখন একটি উন্নয়নশীল দেশ। এই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। নারী- পুরুষ সকলের অংশগ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে এই উন্নয়ন ধরে রাখার জন্য। সামনের পথ নির্ধারণেই শিল্পের সবচেয়ে বড় ভূমিকা রয়েছে। ভূমিকা রয়েছে শিল্পীদের, তাদের নানা পন্থা সমাজ-রাজনীতি-দর্শনের পথ বাতলে দেয়। যে দেশ যত উন্নত সে দেশের শিল্প-সংস্কৃতিও তত উন্নত। শিল্পী আইভি জামান- এর এই প্রদর্শনী আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিল্পের প্রতি আগ্রহী করে তুলবে বলে তিনি আশাবাদ জানান।
অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বলেন, ভারতীয় ভাস্কর্যরীতি আইভি জামান প্রত্যাখ্যান করেছেন, একই সঙ্গে ইউরোপের ভাস্কর্যের আধুনিকতা জয় করেছেন। ক্লাসিজমকে কাউন্টার করতে গিয়ে আইভি একটা কল্পনাকুশল, অবিচ্ছেদ্য স্পেস স্ট্যাচুগুলোর চারপাশে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এই ছড়িয়ে দেওয়ার অর্থ পাথরের ব্লক কিংবা মার্বেলের ব্লক কিংবা কাঠের ব্লক দিয়ে স্পেসকে প্রতিরোধ করেছেন। এই প্রতিরোধের মধ্যে দিয়ে তিনি অ্যাবস্যুলেটকে খুঁজে পেয়েছেন। তার অর্থ তিনি বিভিন্ন ফর্ম খোদাই করেছেন, যেভাবে ফর্ম সব বিভিন্ন দূরত্ব থেকে দেখি। এই দেখা, বিভিন্ন দূরত্ব থেকে ফর্মগুলো দেখা, একটা অ্যাবস্যুলেট দূরত্ব ফর্মগুলোর ওপর আরোপ করা।