ঢাকা, ০১ জুলাই ২০১৮। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের উপাদান জামদানি বয়নশিল্প । বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের যৌথ উদ্যোগে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘ঐতিহ্যবাহী জামদানি নকশা’ শীর্ষক একটি অনন্য নকশা গ্রন্থ। এই গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠান বিকেল ৪টায় কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে আয়োজন করা হয়।
প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান নূর এমপি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া স্টিফেন ব্লুম বার্নিকাট। গ্রন্থ পর্যালোচনা করেন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক জনাব ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সভাপতি জনাব মো. রফিকুল ইসলাম, গ্রন্থের প্রধান গবেষক জনাব চন্দ্র শেখর সাহা এবং প্রকল্প সমন্বয়ক জনাব শাহিদ হোসেন শামীম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক জনাব মো. আব্দুল মান্নান ইলিয়াস ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মাননীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান নূর এমপি বলেন, জামদানি মূলত ইতিহাসখ্যাত ঢাকাই শাড়ি মসলিনেরই একটি প্রজাতি। জামদানি ঢাকা জেলার বিশেষ ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প। বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে জড়িয়ে রয়েছে জামদানি শিল্পের নাম।বাংলাদেশের অহংকার হিসেবে চিহ্নিত এ শিল্পের ভেতরের যে ঐশ্বর্য ছড়িয়ে আছে আমাদের ঐতিহ্যে, তার ধারক হয়ে আজও জনপ্রিয়তায় অনন্য হয়ে আছে জামদানি বয়ন। জামদানির প্রসারে যাদের সীমাহীন অবদান রয়েছে তারা বর্তমানে খুবই ম্রিয়মান। ব্যক্তিস্বার্থ জামদানি শিল্পকে গ্রাস করে ফেলছে।
জনাব ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, জামদানির নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে। ‘জামদানি’ শব্দটি ফারসি শব্দ। ফারসিতে ‘জামা’ শব্দের অর্থ কাপড় ও ‘দানা’ শব্দের অর্থ হল বুটি। অর্থাৎ ‘জামদানি’ শব্দের অর্থ হল বুটিদার কাপড়। জামদানি শাড়ির আগের সব বিখ্যাত ও অবিস্মরণীয় নকশা ও বুননের অনেকগুলোই বর্তমানে বিলুপ্ত প্রায়। নবীন কারিগররা অধিকাংশ নকশাই বুনতে জানেন না। এই গ্রন্থে আদি বনন কৌশল আর হারিয়ে যাওয়া নকশা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা হয়েছে যাতে বাংলাদেশের দুর্লভ কারুশিল্প ঐতিহ্যের অবশিষ্টাংশকে টিকিয়ে রাখা যায় এবং নতুন কারিগরেরা যাতে এই নকশার ব্যাপারে ধারণা পান।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া স্টিফেন ব্লুম বার্নিকাট বলেন, বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতির ধারক জামদানিকে টিকিয়ে রাখতে হলে সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি। এর ডিজাইন ও ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা যেমন জরুরি, তার চেয়ে বেশি জরুরি তাঁতিদের পৃষ্ঠপোষকতা। কারণ ভালো জামদানি তৈরিতে যে সময় লাগে সে তুলনায় টাকা খুব কম পান তাঁতিরা। তাই তাঁতিদের আর্থিক স্বচ্ছলতা আনার দিকে বেশি নজর দেয়া প্রয়োজন।
জনাব মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, জামদানি শাড়ির মূল আকর্ষণ নকশা বা মোটিফ। এ নকশা সাধারণত কাগজে এঁকে নেয়া হয় না। জামদানির শিল্পীরা নকশা আঁকেন সরাসরি তাঁতে বসানো সুতায় শাড়ির বুননে বুননে। তারা এমন পারদর্শী যে, মন থেকে ভিন্ন ভিন্ন নকশা আঁকেন। পুরো জমিনে নকশা করা একটি শাড়ি তৈরি করতে ন্যূনতম সময় লাগে দুই মাস।
জনাব চন্দ্র শেখর সাহা বলেন, জামদানি শাড়ির দামনির্ভর করে শাড়ির গাঁথুনি এবং সুতার কাউন্টের ওপর। যত বেশি কাউন্টের সুতা, শাড়ির দামও তত বেশি। সেইসঙ্গে নকশা তোলার সুতার কাউন্টও হতে হবে কম এবং নকশাও হতে হবে ছোট ছোট। আগে সুতা ও রেশম ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে জামদানির বুননের সিল্ক, সুতির সুতা এবং নাইলন ব্যবহৃত হচ্ছে। জামদানি বুননের মূল শক্তিই হল সুতা। এই বইটি জামদানির নকশার উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। আমাদের দেশের কারুশিল্পীরা পারিবারিকভাবে সংরক্ষণ করে রেখেছিল এই শিল্পের জ্ঞান। এই গ্রন্থ নবীন শিল্পীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
জনাব শাহিদ হোসেন শামীম বলেন, জামদানি, যে শাড়ির নকশায় প্রাণ পায় কারিগরদের শিল্পভাবনা। অনেকে মনে করেন মুসলমানেরাই ভারতীয় উপমহাদেশে জামদানি শাড়ির প্রচলন করেছিলেন। তবে আজকের জামদানি শাড়ি বাংলার এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীক হলেও এটি কিন্তু পুরোপুরি দেশীয় ঐতিহ্যেরও নয়। বরং মুঘল ও পারসিক ঐতিহ্যের এক সুন্দর মেলবন্ধন জামদানি শাড়িতে মিশে আছে।
সভাপতির বক্তব্যে জাদুঘরের মহাপরিচালক জনাব মো. আব্দুল মান্নান ইলিয়াস বলেন, জামদানি বাংলাদেশের গর্ব কিন্তু কালের বিবর্তনে আমরা ভুলে যেতে বসেছি এই শিল্পকে। আমাদের দেশের কারিগরেরা বংশ পরম্পরায় জামদানি বুননের কৌশল নিজেদের মধ্যে ধরে রেখেছেন। বংশপরম্পরায় জামদানি বয়নশিল্পীরা তাদের পেশার সঙ্গে যুক্ত। এটি বাংলাদেশের সমৃদ্ধ বয়ন উত্তরাধিকারের এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত।