জাদুঘর সমাজের দর্পণ। জাদুঘর জাতির শেকড় সন্ধান করে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর-বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্যের বিশাল সংগ্রহভাণ্ডার। এই সমৃদ্ধ সংগ্রহের মাধ্যমে জাদুঘর জনগণের সঙ্গে সেতুবন্ধন তৈরি করে। তাই জাদুঘর বর্তমানে জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিদিন দেশি-বিদেশি হাজার হাজার দর্শক জাদুঘর পরিদর্শন করে এদেশের গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে জানতে পারছে। জাদুঘরের সঙ্গে জনগণের এই যে সম্পৃক্ততা তা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের মে মাসে বঙ্গবন্ধু এক আলোচনায় জাতীয় জাদুঘর বিষয়ে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা দেন। তাঁর দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানটি মুখর পরিবেশে পথ চলছে।
১৯১৩ সালের ০৭ আগস্ট বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল তৎকালীন সচিবালয়ের (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) একটি কক্ষে ৩৭৯টি নিদর্শন নিয়ে ‘ঢাকা জাদুঘর’ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। ১৯১৪ সালের ২৫ আগস্ট জাদুঘরটি দর্শকদের জন্য খুলে দেয়া হয়। ১৯১৫ সালের জুলাই মাসে ঢাকা জাদুঘর ঢাকার নায়েব-নাজিম-এর নিমতলীস্থ প্রাসাদের বারদুয়ারী ও দেউরীতে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৭০ সালে তদানীন্তন প্রাদেশিক সরকার ঢাকা জাদুঘর প্রযত্ন বোর্ড অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় পরিণত করে। ১৯৭২ সালে সরকারের কাছে জাতীয় জাদুঘর প্রকল্প পেশ করে। ১৯৭৪ সালে জাতীয় জাদুঘর কমিশনের সুপারিশে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে অনুমোদিত হয়। ‘ঢাকা যাদুঘর’ থেকে ‘বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর’-এ রূপান্তর এবং বর্তমান বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বিনির্মাণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ও গুরুত্ব অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর অধ্যাদেশ ১৯৮৩ জারি করে ঢাকা যাদুঘরের সব সম্পদ, নিদর্শন, দায়-দায়িত্বসহ সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সাথে আত্তীকৃত করা হয়। ১৭ নভেম্বর ১৯৮৩ বর্তমান ভবনে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের দ্বারোদ্ঘাটন হয়।
প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য তথা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক উপাদান, প্রত্ননিদর্শন এবং মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রহ জাদুঘরের মূল আকর্ষণ। ঐতিহাসিক নিদর্শনাদি যেমনপ্রস্তর ও ধাতব ভাস্কর্য, পোড়ামাটির ফলক, প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় মুদ্রা, শিলালিপি, তুলট কাগজ ও তালপাতায় লেখা সংস্কৃত, বাংলা ও আরবি-ফার্সি পাণ্ডুলিপি, মধ্যযুগীয় অস্ত্রশস্ত্র, বাংলাদেশের দারু ও কারুশিল্প, নকশিকাঁথা, সমকালীন ও বিশ্বসভ্যতার চিত্রকলা ও ভাস্কর্য, বাংলাদেশের গাছপালা, পশুপাখি, শিলা ও খনিজ ইত্যাদি প্রাকৃতিক নিদর্শনাদি জাদুঘরের মূল সংগ্রহ। জাদুঘরে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, তিনটি মিলনায়তন ও দুটি প্রদর্শনী গ্যালারি রয়েছে। ৯৩,২৪৬টি নিবন্ধিত নিদর্শনসমৃদ্ধ বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম জাদুঘর। ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র শাহবাগে চারতলা ভবনের ৪৫টি গ্যালারিতে প্রায় ৪,১৭৮টি নিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার দেশি-বিদেশি দর্শক জাদুঘর পরিদর্শনে আসেন।